রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কত ভাষায় কত বই লেখা হয়েছে। কিন্তু ‘রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ’ পুরোপুরি আলাদা ধরনের বই। কবিজীবনের যেসব ভাবনা ও ঘটনা সমকালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রতিবেদন কি সংবাদ হিসেবে মুদ্রিত হয়েছিল, তারই সংকলন এখানে। এমনই সব জ্ঞাত, অজ্ঞাত, আপাততুচ্ছ তবু সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যময় খবর এ-গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, যার প্রত্যেকটি রবিজীবনকে কোনও না কোনও দিক থেকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে। স্বদেশ ও বিদেশ থেকে প্রেরিত এইসব প্রতিবেদন রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের যে-উষ্ণ পরিমণ্ডলে বসে লেখা, সেই উষ্ণতা আজও যেন অনুভব করা যায়। প্রথমে তিন খণ্ডে পরিকল্পিত হয়েছিল এই সংকলন। তথ্যবিপুলতার চাপে চার খণ্ডে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে পরবর্তীকালে। এই দ্বিতীয় খণ্ডের সময়সীমা মার্চ ১৯৩২ থেকে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। এই কালখণ্ড রবীন্দ্রজীবনের শেষ পর্ব, মূল্যে ও তাৎপর্যে যা কিনা অশেষ। ঘটনাবহুল এই পর্ব ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন কারণে স্মরণীয়। হিটলার-মুসোলিনী ইউরোপে প্রবর্তন করেছেন ফ্যাসিবাদ, চলেছে চিন-জাপানের দীর্ঘযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হিংস্রতায় পীড়িত কবির অনুভূতি-প্রবণ কোমল মন। আবার, প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে নানা সংঘাতে-যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত ভারত। গোলটেবিল বৈঠক, খসড়া শাসনতন্ত্র, পুনা-চুক্তি, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা, রাজবন্দীর উপর অত্যাচার-নিপীড়ন, গান্ধী-সুভাষ মতদ্বৈধ, কংগ্রেস থেকে সুভাষচন্দ্রের বহিষ্কার, বাংলার কংগ্রেসের দ্বিধাবিভাগ— এমনতর অজস্র রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে উদ্বেল ও উদ্ভ্রান্ত এই দশক। এই জটিল পরিস্থিতির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া যেমন রবীন্দ্রজীবনে, তেমনই রবীন্দ্রসাহিত্যে। তাঁর সাহিত্যকীর্তি অভিযুক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে, কোথাও আবার নিষিদ্ধ হয়েছে রবীন্দ্র-জন্মোৎসব। কবি এই অভিযোগের বিরুদ্ধে ধরেছেন কলম, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে হয়ে উঠেছেন মুখর, নানান পরিস্থিতির চাপে বারবার বেদনাহত। এরই পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বিশ্বভারতীকে। স্থাপিত হয়েছে হিন্দিভবন, চিন-ভবন, সংস্কার সমিতি, লোকশিক্ষা সংসদ। একই সঙ্গে, আর্থিক সংকটে জর্জর বিশ্বভারতী নিয়ে দুশ্চিন্তায় দেশবাসী ও নেতৃবৃন্দের কাছে কবি সাহায্যপ্রার্থী। এই পর্বেই তাঁর অন্ত্যপর্বের সাহিত্যকৃতি পরিণতির পূর্ণ মোহনায় গিয়ে মিশেছে, সংগীতচিন্তায় দেখা দিয়েছে নতুনতর ভাবনার বাঁক, চিত্রশিল্পে ঘটেছে অসামান্য স্ফুরণ। ঘটনাবহুল এই দশকে কবিকে ঘিরে ছোট ও বড় নানা সংবাদ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এইসব সংবাদ সমকালীন ইতিহাসেরই এক-একটি অমূল্য দলিল। এই সংকলনে সেইসব দলিলই সংকলিত হয়েছে। সটীক, সুচিন্তিত বিষয়ভাগে বিন্যস্ত হয়ে। পাঁচটি যে-বিষয়বিভাগ এই দ্বিতীয় খণ্ডে সেগুলি হল—‘জন্মোৎসব’, ‘বিশ্বভারতী’, ‘সংগীত, অভিনয় ও চলচ্চিত্র’, ‘চিত্রকলা’ ও ‘দেশ সমাজ সরকার’। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় পরিবেশিত সংবাদের প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত। এর কোনওটিই ব্যক্তিগত স্মৃতিনির্ভর কাহিনী নয়। দ্বিতীয় কি তৃতীয় সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যমালাও নয়। কবিজীবনের সমকালীন ঘটনারই ধারাবাহিক, বিষয়ানুসারী টুকরো ইতিহাস। এই গুরুত্বের কথা ভেবেই প্রথমের মতো এ-খণ্ডেও মূল সংবাদ-কর্তিকা বা প্রতিবেদনগুলির শিরনামা, যতিচিহ্নের প্রয়োগ, বাক্যবিন্যাস ইত্যাদির কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন রূপে গণ্য হবার যোগ্য ‘রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ’।
[Source: Ananda Publishers]
Reviews
There are no reviews yet.